শিক্ষাঙ্গন

মায়ের শূন্যতায় যেভাবে দিন পার করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

প্রিন্ট
মায়ের শূন্যতায় যেভাবে দিন পার করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

ছবি : প্রতীকী ছবি


প্রকাশিত : ১১ মে ২০২৫, দুপুর ১:৩৫ আপডেট : ১১ মে ২০২৫, দুপুর ১:৪৪

যার মাধ্যমে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ মিলে তিনিই হলেন মমতাময়ী মা। ‘মা’ একটি ক্ষুদ্রতর শব্দ, কিন্তু এতে লুকানো আছে পুরো পৃথিবীর ভালোবাসা, আশ্রয় আর প্রশান্তি। সন্তানের পারিবারিক ও প্রাথমিক শিক্ষার কারিগর হলেন \'মা\'। মা সন্তানদের নিজের সুশীতল ছায়াতলেই সারাজীবন আগলে রাখেন। সময়ের পরিক্রমায় তিনি সন্তানের হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে উঠেন। 

একজন সন্তানের অতি আপন স্থান হলো মাতৃকোড়। প্রতিটি সন্তানই মায়ের অঙ্কে শুয়ে জীবন পার করে দিতে চায়। কিন্তু ইহজাগতিক বাস্তবতায় বয়স বাড়ার সাথে সাথে দূরত্ব বেড়ে যায় মায়ের সাথে। কখনো কখনো দূর থেকে বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হয় মাকে ছাড়া। বহুবছর কেটে যায় সেই চিরচেনা মুখখানি না দেখে।

স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন শুরু হয়। কিন্তু সেই জীবনে শুরু থেকে আমৃত্যু স্থায়ীভাবে আর বাড়িতে ফিরে হয়না অনেকের। অনেকে পড়াশোনা সুবাদে পাড়ি জমান দেশের বাহিরে। কখনও সে দূরত্ব অতিদূর পথের দূরত্ব, বহুবছরের দূরত্ব হয়ে যায়। সেই মমতাময়ী মায়ের আচঁল ছেড়ে বহুদূরে এসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে উদাসীন সময় কাটে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর। কেউ মায়ের শূন্যতা অনুভব করে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেন। সময় পেলেই কেউ বাড়িতে যায় কারো আবার যাওয়ার ফুরসত মেলে না। হোটেল ও ক্যান্টিনের খাবার মুখে নিতেই মনে পড়ে সেই মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ। কেউ কেউ মায়ের তাড়নার অভাবে ভুলে যায় ঠিকমতো খাবার খেতে।

মাকে ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন কেমন কাটছে দেশ ও দেশের বাহিরে তা নিয়ে লিখেছেন দ্যা ফিনানশিয়াল পোস্টের প্রতিনিধি তানভীর মাহিম। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন কিভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত মায়ের সাথে কাটানো সেই ছোট বেলার স্মৃতি রোমন্থন করে দিনাতিপাত করছে। আরও জানিয়েছেন মায়ের অবর্তমানে কাটানো বেদনাবিধুর দিনের কথাগুলো।  

মায়ের একজোড়া হাতের তাড়নার স্মৃতি রোমন্থন করে অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি অনুষদের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন‚ ‘এখানে দেশের অনেক কিছুই আছে মিস করার মতো, চা আড্ডা সিনিয়রদের সাথে বা নূরের সাথে কাজের বাহানায় ঘুরা। আছে রাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উল্কাপাত দেখা আর আছে নদীর তীরে টুকরো কাগজ বিছিয়ে ইফতার করা। কিন্তু এসব আমারে তাড়না দেয় না, যা তাড়না দেয় তা হলো একটা আঁচল! যে আঁচলে খাবার শেষ করে আমি হাত মুছতাম অথবা কোথাও থেকে এসে মুখে পানি ছিটকে মুখ। আমারে তাড়না দেয় একজোড়া হাত, যে হাত আমারে ভাত মেখে দিতো আর সে কণ্ঠস্বর যা শুনে সকাল পেড়িয়ে দুপুরে আমি ঘুম থেকে উঠতাম। আমারে তাড়না দেয় আমার আম্মার অনুপস্থিতি। বাকি সব বাদ দিলেও আম্মারে ছাড়া আমার সব খালি খালি লাগে, দুনিয়া অন্ধকার মনে হয়। আম্মারে ছাড়া আমার দুনিয়া অচল!’

দিল্লীতে বসে মায়ের স্মৃতি রোমন্থন করে শারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সৌরভ ভূইয়া বলেন‚ ‘বাকি সময়টা যেকোনোভাবে কাটানো গেলেও, অসুস্থতায় মা কে বড্ড মনে পরে। সেবা করার মতো কেউ থাকে না। খাইয়ে দেয়ার মতোও কেউ নেই। জীবনের প্রথম মাকে ছড়া ঈদ করতে যেয়ে, সেদিন মনকে মানাতে পারিনি। ঈদের দিন মনে হচ্ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই। আসলে যেখানেই থাকিনা কেন মায়ের সঙ্গ বরাবর শৈশবে নিয়ে যায়। পৃথিবীর সব মায়েরা ভালো থাকুক। শুভ মাতৃ দিবস।’

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নওশাদ সরকার নোমান বলেন‚ ‘মায়ের ছায়া থেকে বেড় হয়ে কত দূর চলে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। প্রতিবার বাড়ি থেকে আসার সময়, আমার প্রয়োজনের ছোট ছোট জিনিস গুলোও মায়ের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, মনে করে ব্যাগে গুঁজে দিয়ে দেয়। প্রতিদিন কম করে হলেও একবার ফোন কল দিয়ে অবস্থা জানতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নানা রকম কাজে-অকাজে জীবন কত ব্যস্ত হয়ে পরে! মাকে ছাড়াও দিব্যি চলে যায় দিনটা। কত অপরিচিত মানুষের সাথে মিশতে হয়, আপন করে নিতে হয়। তবে যখনই অসুস্থ হই, মন খারাপ থাকে, কিংবা জ্বর জ্বর লাগে , তখন মনে হয় পৃথিবীর কোনো মানুষই যেন মায়ের মতো আপন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কতটুকু স্বাবলম্বী হতে পারবো জানা নেই- তবে মায়ের উপর যে নির্ভরশীলতা ছোট বেলায় তাঁকে অবলম্বন করে হাঁটার মাধ্যমে শুরু হয়েছে, তা মনে হয় আমৃত্যু থেকে যাবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শফিউল আলম বলেন‚ ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সকাল বেলায় এখন আর কেউ বলে না যে‚ ‘নাস্তা রেডি, উঠে পর।’ তাই ঠিকমতো খাওয়াও হয় না। এ কারণেই সকালের নাস্তা মিস যায়। ক্যান্টিন, ডাইনিং, হোটেল— সবখানে খাই, কিন্তু কোথাও মায়ের হাতের সেই তৃপ্তিটা আর নেই। যদিও মায়ের সাথে ফোনকলে কথা হয় প্রতিদিনই তবুও মনে হয় প্রতিটি মুহূর্তেই মিস করছি মাকে। প্রতিটি মুহূর্তে মায়ের অভাব অনুভব করি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মাছুম সরকার বলেন‚ ‘দিনের শুরু ফজর নামাজ পড়ার জন্য আমার আম্মু আমাকে ডেকে তুলতেন, তারপর কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তবে পাঠাতেন। তারপর খাইয়ে স্কুলে পাঠাতেন, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা সব দিয়ে আগলে রাখতো। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকে ছাড়া জীবন যেন দুর্বিষহ! প্রতিটা মুহূর্ত মা\'কে ছাড়া জীবন শূন্য ও অর্থহীন মনে হয়। আম্মু থাকে কুমিল্লা, আর আমি থাকি চট্টগ্রাম। মা খাবারের বিভিন্ন আইটেম খাওয়ার জন্য রান্না করে খাওয়াতো, এখন মেস ও হলে যেটা রান্না হয়, সেটাই খাওয়া হয়। পড়াশোনা, বিভিন্ন কাজে মনে হয় মাকে ছাড়া আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহায়। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে মাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে মার বিভিন্ন শাসন। মহান আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আমার পিতামাতাকে নেক হায়াত ও হিফাজত করুক।’

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নূর মোহাম্মদ পরশ মনি বলেন‚ ‘একটা কথা প্রচলিত আছে—যে একবার পড়াশোনার জন্য ঘর ছাড়ে, সে আর পুরোপুরি ঘরে ফিরতে পারে না। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে পরিবারের বাইরে, বড় কোনো ছুটি না পেলে বাসায় ফেরা হয় না। তবু প্রতিদিন রাত ৯টায় ফোনটা বেজে ওঠে—চোখ বন্ধ করেই বুঝে যাই, এটা নিশ্চয়ই মা। সারাদিনের ক্লান্তি যেন মায়ের কণ্ঠেই শান্তিতে মিলিয়ে যায়। দূরে থাকি ঠিকই, কিন্তু শরীরে একফোঁটা অসুখ হলেও মায়ের উদ্বেগ যেন থামে না। মাঝে মাঝে ফোনে বলে, “বাবা, কবে আসবি?” বলি, “এইতো, কিছু দিনের মধ্যেই।” তারপরই তাঁর প্রস্তুতি শুরু—ছেলের পছন্দের সব কিছুই এনে রাখেন। বাড়িতে ফিরলে মা’র চোখে খুশির যে ঝিলিক দেখি, সেটা কোনো ভাষায় বোঝানো যায় না। এই ব্যস্ত জীবনে মা-ই আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। কাছে না থেকেও মা সবসময় বলেন, “আমি তো তোকে নিয়েই আছি।” সত্যিই, মা-ই আমার পরিপূর্ণতার নাম।’